পৃথিবীর নিষ্প্রভ নীল বিন্দু (Pale Blue Dot of Earth)


‘নিষ্প্রভ নীল বিন্দু’ হচ্ছে পৃথিবী গ্রহের একটি আশ্চর্যজনক ছবি । এটি এমন একটি দুর্দান্ত ও দুর্লভ ছবি, যেটিকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবী থেকে ৬.৪ বিলিয়ন কিলোমিটার (৪ বিলিয়ন মাইল বা ৬৪০ কোটি কিলোমিটার) দূরে মহাশূন্যে থাকা ভয়েজার ১ রোবোটিক মহাকাশ যান থেকে ধারণ করা হয় । যে ছবিতে মহাকাশের বিশালতার মাঝে বিস্তৃত সূর্যালোক রশ্মির বন্ধনীতে “পৃথিবী” অতি ক্ষুদ্র একটি বিন্দুর মতো দেখা যায় । এখানে ফ্যাকাশে বিন্দুটিই পৃথিবী । অপার মহাশূন্যের প্রেক্ষাপটে এক ফালি সূর্যরশ্মির ভিতর পৃথিবী ধূলিকণার মতো ভাসছে । আমাদের এ সবুজ পৃথিবীতে সূর্য থেকে আলো আসতে সময় লাগে ০৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড এবং দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার । তাহলে একবার চিন্তা করুন ছবির ঐ ক্ষুদ্র বিন্দুটি কতদূর, যেখানে আপনি বসবাস করেন? এ ছবিতে পৃথিবীর আকার ০.১২ Pixel (১ মেগাপিক্সেল = ১ মিলিয়ন পিক্সেল) । পৃথিবীর এ প্রস্ফুটিত অনন্য চিত্রটি বেগুনি, নীল এবং সবুজ রঙে বিশোধন (ফিল্টার) করার মাধ্যমে নেয়া হয়েছিল । দিনটি ছিল Valentine’s Day । নাসা এর ভয়েজার ১ মিশনের জন্য ভালোবাসা দিবসটি বিশেষ হয় । দূরবর্তী মহাশূন্য থেকে ভয়েজার ১ মহাকাশ যানের ১৫০০ মিঃমিঃ উচ্চ-নির্ণয়কর সংকীর্ণ কোণের ক্যামেরার (Narrow-Angle Camera) সাহায্যে পৃথিবী গ্রহের ধারণকৃত Family Portrait সিরিজের আইকনিক ‘নিষ্প্রভ নীল বিন্দু’ ছবিটি সত্যিই উত্তেজনাকর । যা হৃদয়কে টানছে । বিশাল মহাবিশ্বে ক্ষুদ্র পৃথিবীকে আরো নাটকীয় করে তুলছে । এটি সেই নম্রতা যা বিজ্ঞান আমাদের দেয় । বিশদ বিশ্লেষণে পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে ক্যামেরাটি চাঁদকেও শনাক্ত করেছে, তবে বিশেষ প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই দৃশ্যমান হওয়ার মতো অস্পষ্ট । যাক সে কথা, এটি এমন একটি অনুপ্রেরণাদায়ী পৃথিবী গ্রহের বিখ্যাত ছবি যেখানে ‘নিষ্প্রভ নীল বিন্দু’ অর্থাৎ পৃথিবী নামক ক্ষুদ্র বিন্দুটি আমাদের আবাসস্থল এবং সে সম্পর্কে পরম বিস্ময় জাগিয়ে তুলছে । অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাঝে এ গ্রহটি নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি বিন্দু, যেখানে আমাদের সবকিছু এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল । মায়ের কোলের মতোই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল । যদিও কিছু মানুষের নির্বিচার, হিংসাত্মক ও নৃশংস কর্মকাণ্ড এমন সুন্দর ধরিত্রীকে অনিরাপদ করে তুলছে । প্রকৃতপক্ষে, যা অপ্রত্যাশিত । তবুও, স্বপ্ন দেখি এ মৃত্যুন্মুখ গ্রহে টিকে থাকার । পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সূর্যালোকের স্থিতিস্থাপক আলোর বিচ্ছুরণ বা তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ (Rayleigh Scattering ) ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিস্ময়কর এ ছবিতে পৃথিবী একটি ফ্যাকাসে নীল বিন্দুর মতোই আবির্ভূত হয়েছে । ভয়েজার ১ মহাকাশ যানটি যখন তার মিশনের উদ্দেশে সৌরজগৎ ছেড়ে অসীম মহাকাশের আরো গভীরে অগ্রসর হচ্ছিল সে সময় কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গ্রহ বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান যোগাযোগকারী এবং ভয়েজার বিজ্ঞান দলের সদস্য Edward Carl Sagan নাসাকে অনুরোধ করে যে, ঐ দূরত্ব থেকে যানটির ক্যামেরা দ্বারা যেনো পৃথিবীর একটি চিত্র ধারণ করে রাখা হয় । মহাকাশযানটি গভীর মহাশূন্যের দিকে যাওয়ার পথে হঠাৎ চারদিকে ঘুরতে থাকে এবং পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখে নক্ষত্রে ভরা আকাশের উপর গ্রহগুলোর এক চমকপ্রদ বিন্যাস । যেখানে নীলাভ নেপচুন, নীল-সবুজ বরফ দৈত্য ইউরেনাস, বলয়যুক্ত শনি, গ্যাসীয় দানব বিশাল বৃহস্পতি, উজ্জ্বল সাদা শুক্র, ক্যামেরার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সূর্যালোক দ্বারা অস্পষ্ট লোহিত মঙ্গল, সূর্যের খুব কাছাকাছি বুধ, ভীষণ অন্ধকারে ম্লান হওয়া বামন গ্রহ প্লুটো খুব দূরে খুব ছোট এবং একটি অত্যাশ্চর্য ফ্যাকাশে নীল জলময় পৃথিবী । অপার মহাশূন্যের দূরবর্তী স্থান থেকে এটি সৌরজগতের প্রথম প্রতিকৃতি । অসাধারণ সুন্দর পৃথিবীর এ ছবিটি ধারণ করার চৌত্রিশ মিনিট পর ভয়েজার ১ মহাকাশ যানের ক্যামেরা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এবং এটিই ছিল তার শেষ ছবি । যদিও কিছু বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ ছিল যে, সূর্যের এতো কাছাকাছি (মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাবে) পৃথিবীর ছবি তোলা মহাকাশযানটির Imaging System কে অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত করার ঝুঁকি থাকতে পারে । যাই হোক, পরবর্তীতে এ অদ্ভুত ছবিটি দেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান মহাশূন্যে সূর্যের আলোয় ভেসে থাকা ধুলোর ন্যায় ঐ ছোট্টো কণাটির (পৃথিবী) নাম দেন ‘নিষ্প্রভ নীল বিন্দু’ বা ‘Pale Blue Dot’ । তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘নিষ্প্রভ নীল বিন্দু: মহাকাশে মানব ভবিষ্যতের দৃষ্টিভঙ্গি’ (Pale Blue Dot: A Vision of the Human Future in Space) নামক তার রচিত বইয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছবিটি নিয়ে গভীর চিন্তা ব্যাখ্যা করেন । যেখানে তিনি লিখেছেন: “সেই বিন্দুটির দিকে আবার তাকান । এটিই এখানে । এটিই বাড়ি । এটিই আমরা । এটিতে আপনি যাকে ভালোবাসেন, আপনার পরিচিত প্রত্যেকে, যাদের সম্পর্কে আপনি কখনো শুনেছেন, প্রত্যেক মানুষ যারা ছিলেন, তাদের জীবন কাটান । আমাদের ক্ষুদ্র পৃথিবীর এ দূরবর্তী চিত্রের চেয়ে মানবিক অহঙ্কারের মূর্খতার উত্তম প্রদর্শন সম্ভবত আর নেই ।” তিনি স্বীকার করেছেন যে, “এ ধরণের ছবির খুব বেশি বৈজ্ঞানিক মূল্য থাকবে না । কারণ, মহাকাশ যানটির ক্যামেরার জন্য পৃথিবী খুব ছোট বলে মনে হবে, কোনো বিস্তারিত জানার জন্য । কিন্তু, এটি মহাবিশ্বে মানবজাতির অবস্থানের এক দৃষ্টিকোণ হিসেবে অর্থবহ হবে ।” উল্লেখ্য যে, মার্কিন মহাকাশ বৈজ্ঞানিক কর্মসূচীর অংশ হিসেবে NASA ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে মনুষ্যবিহীন ভয়েজার ১ রোবোটিক মহাকাশ যানকে (Robotic Space Probe) সৌরজগতের বাইরের পরিবেশ, বহিঃসৌর গ্রহজনিত বিষয়, Heliosphere, Heliopause, Interstellar Wind এবং নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যবর্তী এলাকা গবেষণার জন্য মহাশূন্যে প্রেরণ করে । মহাকাশ যানটির ওজন: ৭২২ কিলোগ্রাম বা ১৫৯২ পাউন্ড । ভয়েজার ১ মহাকাশ যান ৫ই মার্চ ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে সৌরজগতের সর্ববৃহৎ গ্যাস দানব গ্রহ বৃহস্পতিকে অতিক্রম করে এবং ১২ই নভেম্বর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাসীয় দৈত্য শনি গ্রহ ব্যবস্থার সম্মুখীন হয় । এটিই সর্বপ্রথম আমাদের সৌরজগতের বিশাল দুটি গ্রহ এবং তাদের প্রধান উপগ্রহগুলো সম্পর্কে বিশদ তথ্য ও চিত্র পাঠাতে সক্ষম হয় । ভয়েজার ১ হচ্ছে প্রথম মহাকাশযান যেটি Heliosphere অতিক্রম করে, এটি সেই সীমানা যেখানে আমাদের সৌরজগতের বাইরের প্রভাবগুলো সূর্যের তুলনায় অত্যধিক শক্তিশালী । পরবর্তীতে ২৫শে আগস্ট ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ভয়েজার ১ মহাকাশ যানটি Hydrogen Wall এবং Heliopause এর সীমানা অতিক্রম করে আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে প্রবেশ করে । বিস্ময়কর যে, মানবজাতির ইতিহাসে এটিই হচ্ছে মানবনির্মিত প্রথম বস্তু যেটি সৌরজগতের সীমানাকে ছাড়িয়ে যায় । ১১ই নভেম্বর ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ভয়েজার ১ মহাকাশ যান পৃথিবী থেকে ১৩০.২৯ AU (প্রায় ১২ বিলিয়ন মাইল) দূরত্ব অতিক্রম করে, যা পৃথিবী থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব । এ মিশনটি পরিচালনা করে NASA (National Aeronautics and Space Administration) এবং JPL (Jet Propulsion Laboratory) । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডোনায় অবস্থিত জেপিএল সংস্থাটি নাসা এর জন্য মনুষ্যবিহীন নভোযান তৈরি এবং পরিচালনা করে থাকে । চলমান মিশনে থাকা ভয়েজার ১ মহাকাশ যানটি ৬৪০০০ কিঃমিঃ/ঘন্টা বা ৪০০০০ মাইল/ঘন্টা গতিতে বর্তমানে আন্তঃনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে (Interstellar Space) তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে । তবে, এর ক্যামেরার ছবি তোলার ক্ষমতা আর নেই । এটি নাসা এর মাধ্যমে Deep Space Network (DSN) এর সাথে নিত্যনৈমিত্তিক আদেশ পেতে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে এবং চারটি স্থির-কার্যকর যন্ত্র থেকে যেমন: মহাজাগতিক রশ্মি, চৌম্বক ক্ষেত্র, কম শক্তি চার্জযুক্ত কণা এবং প্লাজমা তরঙ্গের বৈজ্ঞানিক তদন্ত করে তথ্য ফেরৎ পাঠায় । ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল পর্যন্ত এটি পৃথিবী থেকে ১৬২.৭ AU (২৪.৩ বিলিয়ন কিঃমিঃ বা ১৫.১ বিলিয়ন মাইল) দূরত্বে থাকবে এবং তার পূর্বের রেকর্ডটি অতিক্রম করবে । Voyager 1 হচ্ছে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী মহাশূন্যে ভ্রমণরত মানবসৃষ্ট বস্তু । সম্ভবত ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে এ মহাকাশ যানটির জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে । হয়তো, পৃথিবীর মানুষ ভয়েজার ১ মহাকাশ যান থেকে আর কোনো সংকেত (Signal) পাবেন না । যদিও, নাসা এর বিজ্ঞানীরা মহাকাশ যানটিতে সংকেত পাঠানোর মাধ্যমে এর কয়েকটি ইউনিট বন্ধ রেখে জ্বালানি কম ব্যবহার করে আরো কিছু সময় এটিকে সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন । তবুও, মহাকাশ যানটি মহাবিশ্বের মধ্য দিয়ে তার অনন্য যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছে । * তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল (The Internet), উইকিপিডিয়া । ছবি: https://science.nasa.gov/

Leave a comment