মোরগ ফুল (Cockscomb flower)


মোরগ ফুল ।
এশিয়ার নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল (দক্ষিণ, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) এবং ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আফ্রিকায় এর আদি নিবাস । ওয়েস্ট ইন্ডিজ, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকাতেও পাওয়া যায় । এ ফুলগাছটি স্থানীয় পর্যায়ে প্রাকৃতিকভাবেই বন্যফুল হিসেবে জন্মে । এছাড়া এটিকে পুষ্টিকর সবুজ শাকসব্জী হিসেবে চাষ করা হয় । মোরগ ফুলগাছ মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে ঐতিহ্যবাহী খাদ্য (বা শস্য) হিসেবে গ্রহণ করে এবং নাইজেরিয়ার অন্যতম প্রধান পাতাযুক্ত সবুজ শাকসব্জি, যেখানে এটি ‘Soko yokoto’ নামে পরিচিত, যার অর্থ “স্বামীদের স্বাস্থ্যবান এবং সুখী করুন” । এটি পালং শাকের মতো এমন স্বাদ নয় । আর্দ্র অঞ্চলে ভালো কাজ করে ৷ স্পেনে এটি “Rooster comb” নামে পরিচিত ৷ ভারত, বেনিন, কঙ্গো এবং ইন্দোনেশিয়ায় আহার্য সামগ্রী হিসেবে পরিচিত ও ব্যবহৃত হয় । সম্ভবত এটি মূলত ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেছিল ৷ প্রাচীনকাল থেকেই যেখানে ভারতীয়, বার্মিজ এবং চীনা উদ্যানরক্ষক বা মালী এ গাছটিকে মন্দিরগুলির নিকটে রোপণ বা চাষ করেছিলেন, যা দ্বারা বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যুক্ত ছিল এবং এটি রোপণ বা চাষের ফলে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল । দারুণ আকর্ষণীয়, মনোমুগ্ধকর এবং মখমলের মতো মোলায়েম এ রক্তবর্ণ ফুলের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশেও রয়েছে ।
এর ইরেজি নাম: Cock’s comb flower, Red Fox, Feather Cockscomb, Red Spinach, Plumed Cockscomb, Feathery Amaranth, Woolflower, Cockscomb ‘Century Rose’, Wild Cockscomb, বাংলা নাম: মোরগ ফুল / লালমুর্গা / মোরগঝুঁটি, হিন্দি নাম: Lalmurga, মনিপুরী নাম: Haolei, তামিল নাম: Kozhi poo ।
বৈজ্ঞানিক নাম: Celosia argentea var. cristata ।
এটি বিভিন্ন Celosia argentea প্রজাতির Cristate বা Crested প্রজাতি । Celosia genus এর মধ্যে প্রায় ৫০ টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে । এর মধ্যে C. argentea var. argentea বা Lagos spinach (A.K.A. quail grass, Soko, Celosia, Feather cockscomb, Silver cockscomb), Celosia argentea var. cristata, C. argentea var. plumosa Voss (Feathery amaranth, Plume Cockscomb, Plumed Celosia) ইত্যাদি নানা বৈচিত্র্যের প্রজাতি । পূর্ব আফ্রিকার উচ্চভূমিতে এ উদ্ভিদগুলি Swahili নামে সুপরিচিত । এছাড়া Celosia spicata, যেটি গম সেলোসিয়া (Wheat celosia) নামেও পরিচিত । এ প্রজাতিটির ফুলের মাথাগুলি গমের মাথা বা বোতল ব্রাশের (Bottle brush) সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ । তবে Celosia plumosa প্রজাতিটি Prince of Wales feather হিসেবে পরিচিত এবং ভারত ও জাপানে আগাছা হিসেবে বিবেচিত হয় । গাছটি প্রায়শই হরিণ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয় ।
Amaranthaceae পরিবারভুক্ত একটি উদ্ভিদ ।
গণ: Celosia (Celosia নামটি এসেছে প্রাচীন গ্রীক শব্দ κήλεος (কেলিয়স) বা Kelos থেকে, যার অর্থ হচ্ছে ‘জ্বলন্ত’ বা ‘Burned’)
প্রজাতি: C. argentea ।
কান্ডের ঠিক অগ্রভাগে মোরগের মাথা’র লাল ঝুঁটির মতো আকৃতির কারণেই এর নাম মোরগ ফুল । তবে বাংলাদেশে অঞ্চল ভেদে মোরগঝুঁটি ও লালমুর্গা নামেও পরিচিতি রয়েছে । প্রায় সর্বত্রই এটির দেখা মেলে । মোরগ ফুল বর্ষজীবি গুল্ম জাতীয় ভেষজ উদ্ভিদ । এ গাছটি উষ্ণতা প্রিয় এবং কিছুটা খরা সহনশীল, তাই শুকনো পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম উপায়ে বৃদ্ধি পায় । ঠান্ডার প্রতি খুব সংবেদনশীল হওয়ার কারণে হিমশীতল আবহাওয়ায় বাঁচতে পারে না । এ বর্ণময়-রঙিন-প্রাণবন্ত মোরগফুল গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত ঋতুর ফুল । চাষ করার দুই-তিন মাসের মধ্যেই গাছে মোহনীয় ফুল ধরে এবং গাছটি কয়েক মাসের মধ্যে প্রকৃতির নিয়মেই মৃত্যু ঘটে । ফুলগুলি প্রায় ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে । পরিপক্ক ফুলের মাঝে ডাঁটা বীজের মতো বীজ হয় । প্রতিটি ফুল থেকে একটি উচ্চ সংখ্যক বীজ উৎপাদিত হতে পারে, প্রতি গ্রামে ১৫০০ বা প্রতি আউন্সে ৪৩০০০ পর্যন্ত মসৃণ-চকচকে বীজ থাকে । বিভিন্ন ধরণের আকর্ষণীয় সুন্দর ফুলগুলি হচ্ছে Gypsy Queen, Red Velvet, Fan Dance Scarlet, King Coral, Crested Armor, Forest Fire, Flamingo Series (Flamingo Feathers), Arrabona Red, Fresh Look Red, Fresh Look’ Mix, Plumed Castle ইত্যাদি । এটি একটি শোভাময় পল্লবগুচ্ছ ও ফুল, সর্বোপরি সৌন্দর্যবর্ধক গাছ । গাছের কান্ড পুরু ও নরম, দেখতে লালচে বা সাদা । শাখা-প্রশাখা বের হয় । এর গায়ে অসংখ্য গিঁঠ থাকে । পাতা লম্বা, এর শিরা-মধ্য শিরা সুস্পষ্ট এবং পাতার অগ্রভাগ বর্শার ফলা আকৃতির । চটকদার, স্বতন্ত্র এবং সূক্ষ্মতাপূর্ণ বিভিন্ন দুর্দান্ত রঙের ফুলগুলি পালকগুচ্ছ মোমবাতির শিখা, প্রবাল ও মস্তিষ্কের অনুরূপ কিছু মনে হয় । অপরূপ সুন্দর উজ্জ্বল রঙের মোলায়েম পালকের মতো ফুলগুলি অনেকগুলি ছোট ছোট ফুলের সমন্বয়ে গঠিত । বলতে গেলে, ছোট ছোট ফুলে ঠাসা মঞ্জরি । পুষ্পমঞ্জরির ধরণ হচ্ছে Spike । মোরগ ফুল ফোটে থোকায় থোকায়, উজ্জ্বল রঙের কারণে পোকামাকড় ও মানুষকে আকৃষ্ট করে তীব্রভাবে । বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের রঙ ভিন্ন হয় । লাল, কমলা, ক্রিমযুক্ত হলুদ, হালকা বেগুনি থেকে গোলাপী, সাদা, রূপালি, সোনালী, Magenta, Apricot, Grey এবং কিছু ক্ষেত্রে দোআঁশলা বা সংকর বা মিশ্ররঙেও (Hybrid) প্রস্ফুটিত হয় । বিবাহের জন্য অপূর্ব ফুলের তোড়া, টেবিল বিন্যাস এবং বহিরঙ্গনে তাজা এবং শুকনো উভয় ফুল দুর্দান্তভাবে প্রদর্শন করে তোলে । মোরগ ফুল তিন ভাগে বিভক্ত হতে পারে; তাদের Spikes, Plumes এবং Crestsগুলি একে অপরের থেকে পৃথক হলেও বৈশিষ্ট্যে অভিন্নতা রয়েছে । ডাঁটা গাছের মতো দেখতে মোরগ ফুল গাছের এ সুন্দর রেশমী ফুলটি গন্ধহীন এবং এ ফুল শুকিয়ে গেলেও দীর্ঘদিন যাবৎ এর উজ্জ্বলতা নষ্ট হয় না । ফুলগুলি উভলিঙ্গ (Hermaphrodite) এবং উদ্ভিদটি Dodecaploidy প্রদর্শন করে । আদর্শ বীজতলায় বা এ ফুলের বীজ বপন করে মোরগ ফুলগাছের বংশ বিস্তার করা যায় । পরবর্তী মৌসুমে চাষ করার জন্য এ ফুলের বীজকে সংরক্ষণ করা যায় । এ গাছে ফুলের পাপড়ি হয় না, তবে কিছু প্রজাতিতে Capsule আকৃতির বা ফাটিয়া যায় এমন শুকনো ফল দেখা যায় । মোরগ ফুলগাছ পর্যাপ্ত পরিমাণ ভেষজ গুণ সমৃদ্ধ । এ গাছের উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে Water, Vitamin C, Minerals, Carotenoids, Protein, Nitrate এবং Oxalate । বিশেষ করে শিকড় এবং বীজের মধ্যে Triterpene saponins সনাক্ত হয়েছে । এছাড়া শিকড়ের মধ্যে Sugar এবং পাতা ও কান্ডে Flavonoid রয়েছে । চুলকানি, মুখের ঘা, অতিরিক্ত প্রস্রাব, চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং রক্ত আমাশয় চিকিৎসায় এ ফুলগাছ ব্যবহৃত হয় । কোরিয়ায় প্রথাগতভাবে মিষ্টান্ন, চালের পিঠা এবং মদ্যপযুক্ত পানীয় হিসেবে ফুলগুলিকে চারিত ও সুশোভিত করে ব্যবহৃত হয় । প্রায় সকল প্রকার সমৃদ্ধ মাটিতেই মোরগ ফুলগাছ জন্মে ৷ বিশেষত সূর্য আলোকিত উর্বর দো-আঁশ মাটিতে বেশ ভালো হয় । গাছটি ৬.০ থেকে ৭.০ এর pH মাত্রায় মাটি পছন্দ করে । প্রায় ৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (60 °F) বা ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (16 °C) মাটির তাপমাত্রা গাছটি বৃদ্ধির জন্য আদর্শ । এ উদ্ভিদ বা গাছের জন্য ক্ষতিকর কয়েকটি ছত্রাকজনিত রোগ (Powdery mildew, Edema, Fungal leaf spot) এবং পোকামাকড় বা কীটপতঙ্গ রয়েছে । যদিও কিছু Aphids, Spider mites, White filies গাছটিকে খেয়ে ফেলার জন্য বেশ পরিচিত । এ গাছটি প্রায়শই উচ্চতা ৩০ সেন্টিমিটার (০১ ফুট) পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় । এছাড়া এ জাতীয় কিছু কিছু বামন ধরণের উদ্ভিদ যেমন Jewel Box Mixture, Toreador কেবলমাত্র ০৬ থেকে ০৮ ইঞ্চি (লম্বা) পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় । গাছটিকে জোরে আঘাত করা এবং শামুক থেকে রক্ষা করাও জরুরি । বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ ফুলের চাষ করা হয় ।

https://www.facebook.com/ashrafulalam715/posts/2223214511125207

Leave a comment